এক.
তেজোদীপ্ত রবির তেজস্ক্রিয়তা এখনো ম্লান হয়নি, সবেমাত্র হলদে বরণ। খানিক পরেই সে পূর্ণ গোলাকার রক্তরাঙা হয়ে মেঘনার অশান্ত জলে ডুব দেবে চাঁদ-কুমারীকে আমন্ত্রণ জানাতে। খানিক দূরেই নদীতে অর্ধ হেলেপড়া কড়ই গাছটায় বসে একজোড়া ঘুঘুপাখি বিরহ সুরে ডেকে যাচ্ছে, দখিনা বাতাস বইছে, সবুজ ধানসিঁড়ির আনন্দনৃত্য এখন আর দেখা যায় না।
এই তো গত বছর এই জায়গাটা ছিলো মিয়া বাড়ি। মিয়া বাড়ির তিনদিক জুড়ে শুধু সবুজ আর সবুজ। যেনো মাঠ জুড়ে সবুজ গালিচা বিছানো ছিলো। পুরো গ্রামটার দিকে তাকালে মনে হতো গ্রামটা শুধু হাসছে। অথচ আজ গ্রামটার দিকে আর তাকানো যায় না। ভাঙ্গন, ক্ষুধা, অভাব আর রোগ-বালাই চারদিক থেকে গ্রামটাকে ঘিরে ধরেছে।
'কি জমিদার বেটা, অমন মন খারাপ কইরা বইসা আছো যে?' তৈয়ব জাউল্লা মাথা উঁচিয়ে দেখলো কাদির গাজী। 'কাম-কামাই কিছু যোগাইছো?' আবারো প্রশ্ন করলো কাদের গাজী।
'না মিয়া ভাই।' তৈয়ব জাউল্লা মলিন কণ্ঠে উত্তর দিলো, 'আগে তো গাঙ্গে অভিযান পড়লে খেতে কাম করছো। ওই রাক্ষইসা নদীতো তাও কাইড়া নিলো।
'হ মিয়া ভাই, অহন কী করমু কিছুই বুঝতাছি না। কেন? দেহগা খালের মইধ্যে মিয়ারা পলাইয়া জাটকা মাছ বাছতাছে। তুমি তো অগো লগে যাইতে পার না মিয়া ভাই। আমি জাটকা মাছ ধরমু না।'
'থাহ তুমি সরকার লইয়া, আর না খাইয়া মর।'
দুই.
গভীর রাত। স্তব্ধ পৃথিবী। পৃথিবী পাড়ের মানুষগুলো ঘুমিয়ে গেছে। জেগে আছে আলোর দেবী। দেবী আজ কৃপণতা ভুলে সবটুকু আলো পৃথিবীর গায়ে বিলিয়ে দিচ্ছে। কিছু মানুষ এখনো জেগে আছে, বাড়তি টাকা আয়ের আশায়। এ মধ্য রাতেও খেটে যাচ্ছে যন্ত্রের মতো। জেগে আছে কিছু নিশিকন্যা, ওরা অভাবের তাড়নায় সামান্য কিছু টাকার জন্যে দেহবিক্রি করছে। আর শহরের ওই উঁচু প্রাসাদে বাস করা নিচু মনের মানুষগুলো তা ভোগ করছে। জেগে আছে একজন জীবনসৈনিক অসহায় তৈয়ব জাউল্লা। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে যে তৈয়ব গাজীর বৈঠার আঘাতে মৃতু্য হয় পশ্চিমাদের দালাল রাজাকার, নারীলোভী কালু মাতাব্বরের, দেশ স্বাধীন হওয়ার ৩৯ বছর পরও তার এ বীরত্বের কথা বুক ফুলিয়ে কাউকে বলতে পারছে না তৈয়ব গাজী। কারণ দেশ স্বাধীন হয়েছে কিন্তু গ্রাম বাংলার অসহায় দরিদ্র মানুষরা আজো পরাধীনতার অদৃশ্য শিকল থেকে মুক্ত হতে পারেনি বা দেয়নি। স্বাধীনতার এতো বছর পরও গ্রাম বাংলার মানুষগুলোর অর্থনৈতিক মুক্তি আসেনি। এখনো মাতাব্বরের ছেলেরা গ্রাম বাংলার সহজ-সরল মেয়েদের সরলতার সুযোগ নিয়ে তাদের ধর্ষণ করে গলাকাটা লাশ ফেলে রাখে পাঠক্ষেতে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতে তৈয়ব গাজীর সমস্ত শরীর রাগে-ক্ষোভে কাঁপতে লাগলো।
'হুঁশিয়ার, সাবধান, হুঁশিয়ার সাবধান!'
তৈয়ব জাউল্লা তাকিয়ে দেখলো চৌকিদার হারুন উন্নত টর্চলাইট হাতে ছেঁচড়া চোরের মনে আতঙ্ক ছড়াতে ছড়াতে হেঁটে যাচ্ছে। অথচ বড় বড় চোরের বুকে কেউ কাঁপন ধরাতেও পারে না। এ গ্রামের বড় চোরগুলো কখনো চৌকিদারের হাতে ধরা পড়ে না। কখনো কখনো পুলিশের হাতে ধরা পড়লেও পরেরদিন ফুলের মালা গলায় দিয়ে বেরিয়ে আসে। আর ছেঁচড়া চোর ধরা পড়লে মাথা ন্যাড়া করে গলায় জুতার মালা পরিয়ে পুরো গ্রাম পরিদর্শন করানো হয়। সাথে উত্তম-মধ্যম তো অবশ্যই ফ্রি। আগে এ গ্রামে চৌকিদার দরকার ছিলো না। অথচ স্বাধীন দেশ, এখন চৌকিদার লাগে, পুলিশ লাগে। তাতেও কাজ হয় না। র্যাব-চিতা লাগে। কেনো লাগে, সে অঙ্ক তৈয়ব জাউল্লার মাথায় ঢোকে না। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তৈয়ব জাউল্লা তার ভাঙ্গা জোড়া নৌকার পাটাতনের ওপর চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লো। নিজের একটা হাত পেটের ওপর পড়তেই দুটি চোখ বেয়ে তৈয়ব গাজীর বাঁধভাঙ্গা নোনাজল গড়গড় করে দু'চোখ বেয়ে ঝরতে লাগলো।
আজ সারাদিন এক গ্লাস পানিও তার পেটে পড়েনি। সেকথা তৈয়ব গাজীর খেয়ালই নেই। সেই যে সকালে বাড়ি থেকে না বলে বের হয়েছে, সারাদিন বাড়িতে যায়নি। তৈয়ব গাজীর প্রথম বউটা মারা গেছে; শ্বাসের ব্যারাম ছিলো। কোনো পোলাপাইন ছিলো না। তারপর জীবনটা ভালোই চলছিলো। ঝামেলা দেখা দিলো বুড়ো বয়সে। অসুখ হলে একজন খেদমত করা মানুষের খুব প্রয়োজন। তাই গ্রামের মানুষরা সবাই মিলে নদী ভাংতি মা-বাপহারা হাজেরা বানুর সাথে বিয়ে দেয়। তৈয়ব জাউল্লার বিয়ের পাঁচ বছর পর হাজেরা মা হয়। তৈয়ব গাজীর বুড়ো বয়সে বাপ হওয়ার কোনো সখ ছিলো না। হাজেরাই হুজুর-কবিরাজের কাছে দৌড়াদৌড়ি করে মা হতে পেরেছে। হাজেরা আবারো পোয়াতি। তৈয়ব গাজী ভাবছে। সারাদিন চুলোয় আগুন জ্বলেনি। বউ-পোলা না খাওয়া। কাল সকালে কী করে ওদের মুখ দেখাবে। পোয়াতি বউটার ঔষধের ৫০ টাকা সে কোথায় পাবে!
তিন.
সকালে বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়েই শুনতে পেলো- 'মা, মা, ওমা। খাওন দেও, ক্ষিধা লাগছে তো। ওমা, কিছু খাইতে দাও মা। ওমা কথা কও না কেন? আমার ভুখ লাগছে। ও মা মা। খাওন দাও।'
অসুস্থ হাজেরা অাঁচল দিয়ে চোখ মুছে বললো, 'তোর বাজান রাইতে জাটকা মাছ ধরতে গেছে। বাইত আইতে তোরে তেলে ভাইজা মাছ দিমু।'
'বাজান তো হেই কাইল সকালে গেছে। বাজানের আমাগো কথা খেয়াল নাই...।'
'আছে বাপ। এই তো তোর বাজান আইলো বইলা।'
তৈয়ব জাউল্লা আর স্থির থাকতে পারলো না। মুহূর্তেই এক পশলা নোনা বৃষ্টি তৈয়ব গাজীকে ম্লান করিয়ে দিলো। তৈয়ব জাউল্লা জোর কদমে হাঁটতে লাগলো মেঘনা পাড়ে। দেখলো পাশের বাড়ির হালিম কাঁধে করে কারেন্ট জাল নিয়ে নদীর পাড়ে যাচ্ছে। তৈয়ব গাজীকে দেখে বললো, 'কী কাহা। কই যাও। মুখটা অমন শুকনা কেন?'
'আমি কী করমু হালিম। কিছুই বুঝতাছি না। আজ দুইদিন চুলায় আগুন জ্বলে নাই। বউ, পোলা না খাইয়া আছে। ঘরে জমানো যা আছিলো, সব খাইছি। তোমার চাচীর কানের জিনিসটা শেষমেষ বেইচা দিছি। অহন আর উপায় দেখতাছি না।'
'কেনো তোমারে কইছি না আমাগো লগে লও। জাটকা মাছ ধরি না। তোমার একই কথা- জাটকা মাছ বড় হইলে ইলিশ হইবো। আরে কাহা, হেইডা তো হইলো গিয়া ভবিষ্যৎ। আর ভবিষ্যৎ ভাববো তো ওই বড় লোকেরা। দেহনা আমাগো সাহায্যের টাকা দিয়া হেরা হেগো ভবিষ্যৎ করতাছে। আর তুমি যে সরকারি সাহায্যের আশায় আছ, হেই সাহায্য তোমাগো পেটে পড়বো না। হেই টেকা নেতাগো পেটে যাইবো। হেরা কোটি টেকা খরচ কইরা নেতা হইছে।'
হালিম কথাগুলো যেনো এক তরফাই বলতে লাগলো। তৈয়ব জাউল্লা চুপ করে আছে দেখে হালিম আবারও বলতে লাগলো, 'কাহা এদেশে সরকার বদলাইবো, আমাগো গ্রাম বাংলার মানুষের ভাগ্য কোনোদিন বদলাইবো না। সরকার মুহেই খালি কয় গ্রাম-বাংলার উন্নয়ন না অইলে দেশে শান্তি অইবো না। অথচ হগলেই গ্রাম-বাংলারে সৎ ভাইয়ের নজরে দেহে। যদি মন চায় তো আমাগো লগে লও। জাটকা মাছ ধরি।'
তৈয়ব জাউল্লা চোখ বন্ধ করে কী যেনো ভাবলো। মুহূর্তেই বলে উঠলো, 'হ, আমি যামু। আমি জাটকা মাছ ধরমু, হালিম আমারে নিয়া চলো। আমি জাটকা মাছ ধরমু।'
ওরা মাঝ নদীতে এসে জাল ফেলতে লাগলো। হঠাৎ স্পিডবোটের শব্দ শুনে তৈয়ব জাউল্লার বুকটা কেঁপে উঠলো। হালিম বললো, 'কাহা, তুমি নদীতে ঝাঁপ দেও।'
তৈয়ব পাথর বনে গেলো। মুহূর্তেই কোস্টগার্ডের স্পিডবোটটা নৌকার কাছে চলে এলো। ওরা তৈয়ব গাজীদের পেটাতে লাগলো। একটা আঘাত তৈয়ব গাজীর মাথায় পড়লো। তৈয়ব গাজীর মাথা বেয়ে রক্ত ঝরছে।
তৈয়ব গাজী একজন অফিসারের পায়ে জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলো, 'স্যার, আমারে আর মাইরেন না। আমি আইজ তিনদিন না খাইয়া আছি। আমার কিছু অইলে আমার বউ-পোলা মইরা যাইবো না খাইয়া। স্যার দয়া করেন। আমারে মাইরেন না।'
তৈয়ব জাউল্লার আহাজারি শুনে অফিসারের দয়া হলো। অফিসার তৈয়ব জাউলাকে রেখে সবাইকে হাতকড়া পরিয়ে নিয়ে গেলো।
১৬ অক্টোবর - ২০১১
গল্প/কবিতা:
১৪ টি
বিজ্ঞপ্তি
এই লেখাটি গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষের আংশিক অথবা কোন সম্পাদনা ছাড়াই প্রকাশিত এবং গল্পকবিতা কর্তৃপক্ষ এই লেখার বিষয়বস্তু, মন্তব্য অথবা পরিণতির ব্যাপারে দায়ী থাকবে না। লেখকই সব দায়ভার বহন করতে বাধ্য থাকবে।
প্রতি মাসেই পুরস্কার
বিচারক ও পাঠকদের ভোটে সেরা ৩টি গল্প ও ৩টি কবিতা পুরস্কার পাবে।
লেখা প্রতিযোগিতায় আপনিও লিখুন
-
প্রথম পুরস্কার ১৫০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
দ্বিতীয় পুরস্কার ১০০০ টাকার
প্রাইজ বন্ড এবং সনদপত্র।
-
তৃতীয় পুরস্কার সনদপত্র।
আগামী সংখ্যার বিষয়
লেখা জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৫ নভেম্বর,২০২৪